• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

সারা দেশ

ঈদকে ঘিরে নওগাঁর ‘কুপিয়া’ টুপি যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে

  • ''
  • প্রকাশিত ২৯ মার্চ ২০২৪

নওগাঁ প্রতিনিধি:

নওগাঁর  নারীদের শখের টুপি বানানো এক ঘর থেকে আরেক ঘর হয়ে টুপির গ্রামে পরিণত হয়েছে। নকশা করা এসব টুপি যাচ্ছে ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। ফলে দেশে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। আর এসব টুপি তৈরি করছেন গ্রামীণ নারীরা। টুপি তৈরির আয় থেকে অভাবের সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরেছে। এসেছে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য।

জানা যায়, ওমানের জাতীয় টুপির নাম 'কুপিয়া’যা তৈরি হচ্ছে নওগাঁর মহাদেবপুরের নারীদের নিপুণ হাতে। নারীদের হাতে তৈরি এসব ‘কুপিয়া’ বা টুপির প্রধান ক্রেতা ওমান। এছাড়াও সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, কাতার, পাকিস্তান, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে ‘কুপিয়া’। মানভেদে একেকটি ‘কুপিয়া’ এক থেকে চার হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়।

গৃহস্থালী কাজের ফাঁকে নারীদের হাতে সুই-সুতা ও কাপড়। কারও হাতে সাদা রংয়ের কাপড়। সুইয়ের ফোঁড়ে নান্দনিক নকশা ফুটে উঠছে একেকটা কাপড়ে। বিশেষ কায়দায় সেলাই ও ভাঁজ করে এই কাপড় দিয়ে বানানো হচ্ছে টুপি। এই টুপি যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ওমানসহ বিভিন্ন দেশে।

জেলার তিনটি উপজেলা নওগাঁ সদর, মান্দা ও মহাদেবপুরের প্রায় ৯০টি গ্রামের বিভিন্ন বয়সী প্রায় ৫০ হাজার নারী কারিগর এই বিশেষ ধরণের টুপি তৈরির কাজের সঙ্গে জড়িত।

তবে মহাদেবপুরে উপজেলার খোসালপুর, রনাইল, ভালাইন, সুলতানপুর, কুঞ্জবন, মধুবন, হরমনগর, খাজুর, শিবগঞ্জ, তাতারপুর, উত্তরগ্রাম শিবগঞ্জ, গোয়ালবাড়ি সহ অন্তত ৬০ থেকে ৭০টি গ্রামে বিভিন্ন বয়সী নারী বিশেষ ধরনের এসব টুপি তৈরি করছেন। আর ঈদকে সামনে রেখে তাদের বেড়েছে ব্যস্ততা।

কেউ বাড়ির উঠানেআ বার কেউ দলবদ্ধভাবে টুপি তৈরি করছেন। জানা যায়, খুচরা ব্যবসায়ীরা বিদেশি ব্যবসায়ী দের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন নকশার ছাপ দেয়া সাদা রংয়ের টুপির কাপড় ও সুতা কারিগরদের কাছে পৌঁছে দেন। এসব কাপড়ে সুঁই-সুতা দিয়ে সুন্দর সুন্দর নকশা ফুটিয়ে তোলেন নারী কারিগরেরা।

বোতাম, চেন, দানা ও মাছকাটা নামে চার ধরনের টুপি সেলাই করা হয়। টুপিতে নকশা তৈরিতে সময় এবং শ্রমের ওপর ভিত্তি করে কারিগরদের পারিশ্রমিক দেয়া হয়। কোনো টুপি তে নকশা তুলতে ২০-২৫ টাকা আবার কো নো টুপিতে নকশা করতে ৬০০-৭০০ টাকা পর্যন্ত দেয়া হয়। টুপিতে নকশা তৈরির কাজ একজন নারী কারিগরের মাসে ৩০০০-৪০০০ টাকা আয় হয়। মহাদেবপুরে প্রায় ১৫ বছর আগে শুরু হয়েছিল টুপি তৈরি কাজ। সারা বছরই এসব টুপি তৈরি হলেও রমজানে বেড়ে যায় এসব টুপির চাহিদা। প্রকারভেদে এসব টুপি বিক্রি হয় ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত।

মূলত নারীরাই তৈরি করে এসব টুপি। নারীরা একত্রিত হয়ে গল্পে আড্ডায় করেন টুপি সেলাইয়ের কাজ। তবে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার আরও ১০ উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে এ টুপি তৈরির কাজ। টুপি তৈরির সঙ্গে জেলার প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার নারী জড়িত।

তবে এ কাজে কারিগররা স্বাবলম্বী হলেও সময়ের ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না তারা। এদিকে যে দেশের জাতীয় টুপি বানানো হচ্ছে সেই ওমান দেশটি কোথায় তা ঠিকভাবে জানেনও না অনেক নারী কারিগররা।

প্রায় ১৫বছর আগে জেলার মহাদেবপুর উপজেলায় টুপি ব্যবসা শুরু করেছিলেন ভোলা এবং ফেনী জেলার একদল ব্যবসায়ী। তখন টুপিগুলো তৈরির পর ঢাকার চকবাজার, বাইতুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটসহ বিভিন্ন মার্কেটে পাঠা নো হতো। সেখানকার ব্যবসায়ীরাই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এগুলো রপ্তানি করতেন।
উত্তরগ্রাম শিবগঞ্জ গ্রামের কবিজান বেগম বলেন, স্বামী দিন মজুরের কাজ করে। তার একার আয় দিয়ে আগে টেনেটুনে কষ্ট করে সংসার চলত। অনেক সময় আধপেটা করে খেয়ে থাকতে হত। তবে গত পাঁচ-ছয় বছর টুপিতে নকশা তোলার কাজ শুরু করে এখন সংসার ভালোই চলছে। বাড়িতে হাঁস-মুরগি, ছাগল ও গরু পালন করছে তারা।

কুঞ্জবন গ্রামের ফরিদা বেগম জানিয়েছেন, প্রতিটি টুপি তৈরি থেকে ৪০থেকে ৫০ টাকা করে পেয়ে থাকেন তিনি। দশ বছর আগে স্বামীর সঙ্গে মহাদেবপুর সদরের ঘোষপাড়া এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকা শুরু করেন। এখানে এসে এক বছর পর এক প্রতিবেশির উৎসাহে শুরু করেন টুপিতে নকশা তোলার কাজ। স্বামী ও নিজের আয় দিয়ে এখন সংসার চলছে স্বাচ্ছন্দ্যে।

রনাইল গ্রামের কলেজ ছাত্রী লিপি খাতুন বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি টুপি তৈরর কাজ করে মাসে তিন থেকে চার হাজার টাকা আয় হয়।

এতে কলেজে যাওয়া-আসার খরচ সহ আনুষঙ্গিক কাজে ব্যয় করা হয় এবং পরিবারেও দেয়া হয়। তবে পরিশ্রমের তুলনায় পারিশ্রমিকটা কম পাওয়া যায়।স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, জেলায় প্রায় ৭ জন মহাজন রয়েছেন।

এ মৌসুমে জেলা থেকে প্রায় ৬০-৭০ হাজার পিস টুপি তৈরি করা হবে। যার উৎপাদন খরচ প্রায় ৯ কোটি টাকা। তবে বাজার মূল্য প্রায় ১৬ কোটি টাকা। এগুলো সবই রপ্তানি করা হবে। তবে সরাসরি নিজেরা রপ্তানি করতে পারলে বাড়তি দামে বিক্রি করে লাভবান হতে পারতেন তারা। উপজেলার টুপি ব্যবসায়ী সুজন হোসেন জানিয়েছেন, প্রায় ১৫ বছর ধরে এই এলাকায় বিদেশি টুপি তৈরির কাজ শুরু হয়। আগে শুধু ‘কুপিয়া’ টুপি তৈরি হতো। এটি ওমানের জাতীয় টুপি। এখন পাকিস্তান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, কাতার, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচের বিভিন্ন দেশে এখানকার তৈরি টুপি যাচ্ছে। সারা বছরই আমরা কারিগরদের টুপির অর্ডার দিয়ে থাকে।

তবে রমজান ও ঈদ উপলক্ষে টুপির চাহিদা বেড়ে যায়, ভোলা জেলার পাইকারী ব্যবসায়ী জহির আব্দুল্লাহ জানান, ক্ষুদ্রব্য বসায়ীদের কাছ থেকে টুপি কিনে তা সরাসরি ওমানে রপ্তানি করেন। ওমানেও তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। ওমান থেকে তিনি এই টুপি রপ্তানি করেন মধ্যপাচ্যের বিভিন্ন দেশে।

ওমানে তিনি প্রতিটি টুপি বিক্রি করেন ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায়। তিনিমনের করেন কারিগরদের প্রশিক্ষণ দেয়া গেলে টুপির মান বৃদ্ধিরপাশাপাশি এর চাহিদা ও মূল্য বৃদ্ধি পাবে।

নওগাঁ জেলা বিসিকের উপব্যবস্থাপক এ.বি.এম আনিসুজ্জামান, এ হস্তশিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করতে নারী উদ্যোগতাদের ক্ষেত্রে মাত্র ৫% এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ৬% সুদে ক্ষুদ্র ঋণ চালু রয়েছে। এ খাতের কারিগররা আগ্রহী হলে দেশে ও দেশের বাইরে প্রশিক্ষণ এবং বিপননের ব্যবস্থা করে দেয়া যেতে পারে বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads